শুল্ক অনিশ্চয়তায় আতঙ্কে দেশের পোশাক খাত
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক (Reciprocal Tariff) আরোপের সম্ভাবনায় দেশের পোশাক খাত বড় ধরনের অনিশ্চয়তায় পড়েছে। মার্কিন সরকারের সঙ্গে চলমান উচ্চ পর্যায়ের আলোচনায় সন্তোষজনক অগ্রগতি না হওয়ায় উদ্যোক্তাদের মধ্যে উৎকণ্ঠা বেড়েছে। রপ্তানিকারক ও বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এ শুল্ক কার্যকর হলে বাংলাদেশ বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে এবং ছোট-মাঝারি কারখানাগুলোর অস্তিত্ব হুমকিতে পড়বে। এর ফলে অন্তত ১০ লাখ শ্রমিক চাকরি হারাতে পারেন।
শুল্ক বাড়লে রপ্তানি হুমকির মুখে
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে ১৫-২০ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। প্রস্তাবিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে অনেক উদ্যোক্তার উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে এবং মার্কেট শেয়ার হারানোর শঙ্কা তৈরি হবে। এতে ভিয়েতনাম, ভারত ও পাকিস্তানের মতো প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে অনেক অর্ডার বাতিল বা স্থগিত হওয়ারও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
প্রতিবাদ ও উদ্যোগের অভাব নিয়ে উদ্বেগ
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেছেন, ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে দর-কষাকষির জন্য লবিইস্ট নিয়োগের পরামর্শ দেওয়া হলেও সরকারের তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম মনে করেন, আলোচনা সঠিক পথে এগোচ্ছে, তবে চূড়ান্ত সফলতা পেতে রাজনৈতিক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জরুরি আলোচনার প্রয়োজন
বাণিজ্য উপদেষ্টার নেতৃত্বে আগামী সপ্তাহে তৃতীয় দফা বৈঠকের পরিকল্পনা রয়েছে। উদ্যোক্তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনুকূল দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি দ্রুত করতে হবে, নয়তো ১ আগস্টের পর রপ্তানির ওপর শুল্ক আরোপ শুরু হবে এবং তখন বিপুল পরিমাণ ক্ষতি অনিবার্য হয়ে উঠবে।
প্রভাব পড়ছে রপ্তানির পরিসংখ্যানে
এপ্রিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বড় ধস দেখা গেছে। মে মাসে রপ্তানি কমে দাঁড়ায় ৫২ কোটি ৩২ লাখ ডলারে, যা এপ্রিলের তুলনায় প্রায় ২৮ শতাংশ কম। ৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর থেকেই এ ধস শুরু হয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (EPB) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি ছিল ৮৪০ কোটি ডলার, যার মধ্যে তৈরি পোশাক খাত থেকেই আসে ৭৩৪ কোটি ডলার। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি ছিল মাত্র ২২০ কোটি ডলার। এ ব্যবধান শুল্ক বৃদ্ধির ফলে আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রতিযোগীদের অবস্থান
ভিয়েতনাম বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ২০ শতাংশ শুল্ক সুবিধা পাচ্ছে। পাকিস্তান বর্তমানে ২৯ শতাংশ শুল্ক দিলেও তা কমিয়ে ১০ শতাংশে আনার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের তুলনায় এই হার অনেকটাই সহনীয় এবং প্রতিযোগিতামূলক।
রাজনৈতিক বার্তা
৮ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠির মাধ্যমে জানান, ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হবে। যদিও গত ৭ এপ্রিল তা ৯ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছিল।
উদ্যোক্তাদের বার্তা
বিজিএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি ইনামুল হক খান বলেন, ৭ জুলাইয়ের পর যেসব প্রতিষ্ঠান পণ্য রপ্তানি করেছে, তাদের ক্রেতারা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারেন। ট্যাড গ্রুপের এমডি আশিকুর রহমান তুহিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষির মাধ্যমে বাড়তি শুল্ক কমাতে পারলে এ বাজারেই নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে যেতে পারে। অন্যথায়, বাজার হারানোর আশঙ্কা বাস্তব হয়ে উঠবে এবং তা দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
১০ লাখ পোশাক শ্রমিকের চাকরি হারানোর শঙ্কা, চাপের মুখে অর্থনীতি
যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপে দেশের তৈরি পোশাক খাত গভীর অনিশ্চয়তায় পড়েছে। সবচেয়ে বড় আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এর প্রভাব সরাসরি শ্রমবাজারে পড়বে। নতুন চাকরির সুযোগ না হয়ে বরং বিপুলসংখ্যক শ্রমিক চাকরি হারানোর মুখোমুখি হতে পারেন। এতে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বেড়ে যাবে, যার ফলে পারিবারিক আয় কমবে, আর্থসামাজিক অস্থিরতা বাড়বে এবং দেশের অর্থনীতিতে বিদ্যমান চাপ আরও জটিল হয়ে উঠবে।
সহস্রাধিক কারখানায় ১০ লাখ শ্রমিকের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে
বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ছোট ও মাঝারি মিলে ১,১০০টির বেশি পোশাক কারখানা রয়েছে, যেগুলোতে প্রায় ১০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। ছোট কারখানাগুলোর সংখ্যা প্রায় ৪৫০টি, যেগুলোর বার্ষিক রপ্তানি ৫ মিলিয়ন ডলারের নিচে। প্রতিটি কারখানায় গড়ে ৭০০ শ্রমিক কাজ করেন—যার ফলে এই খাতে প্রায় সোয়া ৩ লাখ শ্রমিক যুক্ত।
মাঝারি কারখানার সংখ্যা প্রায় ৭০০টি, যেগুলোর বার্ষিক রপ্তানি ৫ থেকে ২০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে। এসব কারখানায় গড়ে এক হাজার শ্রমিক থাকেন, যার বড় একটি অংশ নারী। ফলে শুধু মাঝারি কারখানাগুলোতেই ৭ লাখের মতো শ্রমিক কাজ করছেন।
শুল্ক চাপ সামাল দিতে পারবে না ছোট-মাঝারি কারখানা
রপ্তানিকারকরা মনে করছেন, এসব কারখানার আর্থিক সক্ষমতা সীমিত। যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক চাপ তারা বহন করতে পারবে না। এতে তারা নতুন অর্ডার পাবে না, উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং শেষ পর্যন্ত অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এতে লাখ লাখ শ্রমিক চাকরি হারাতে পারেন।
সরকারের করণীয় ও কৌশল
সরকার এই সংকট মোকাবেলায় কিছু কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছে নীতিনির্ধারণী সূত্র। এর মধ্যে অন্যতম হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের অংশ হিসেবে প্রায় ৩ লাখ টন গম ‘জিটুজি’ (সরকার থেকে সরকার) ভিত্তিতে আমদানি করার পরিকল্পনা। যদিও এই গম ভারত, রাশিয়া বা ইউক্রেনের তুলনায় প্রতি টনে ২০–২৫ ডলার বেশি দামে পড়তে পারে, তবুও কৌশলগত সম্পর্ক রক্ষায় সরকার এগিয়ে যাচ্ছে।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে বোয়িং বিমান, তুলা, গ্যাস টারবাইন, সেমিকন্ডাক্টর ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানিতে শুল্ক ছাড় বা সমন্বয়ের বিষয়ও সরকার বিবেচনায় রেখেছে। এসব পদক্ষেপ মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তুলতে এবং আলোচনায় সুবিধা আদায়ে সহায়ক হতে পারে।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাত: তৈরি পোশাক শিল্প (RMG)
যুক্তরাষ্ট্রের রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ নীতির সবচেয়ে বড় শিকার বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির মাত্র ০.২৫ শতাংশ যায়, সেখানে দেশটি বাংলাদেশকে ৩৫ শতাংশ শুল্কের আওতায় এনেছে। এটি ১৪টি লক্ষ্যভুক্ত দেশের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ হারে শুল্ক।
অথচ বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে, যেখানে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কর্মরত, যাঁদের বেশির ভাগই নারী। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় একক রপ্তানি গন্তব্য, যেখানে প্রতিবছর প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়।