ভারতে বিহার রাজ্যের ভোটার তালিকায় সর্বাত্মক সংশোধন করতে সে দেশের নির্বাচন কমিশন যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে দেশের এক ঝাঁক বিরোধীদলীয় এমপি সোমবার দিল্লি পুলিশের হাতে আটক হয়েছিলেন। যাদের আটক করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী ও মল্লিকার্জুন খড়গেও ছিলেন। তবে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই তাদের সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
বিহারে নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি ভোটার তালিকাতে যে ‘এসআইআর’ (স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন) বা বিশেষ নিবিড় পর্যালোচনা সম্পাদন করেছে, তাতে প্রায় ৬৫ লাখ নাম বাদ পড়েছে। কমিশন বলছে, হয় এরা বৈধ ভোটার নন অথবা এই সব নাম সম্পূর্ণ ভুয়া। যাদের একাধিক জায়গায় ভোটার হিসেবে নাম ছিল কিংবা যারা ইতিমধ্যে মৃত, তাদের নামও বাদ পড়েছে বলে কমিশন জানিয়েছে। আগামী নভেম্বর মাসে বিহারে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা। তার আগে ভোটার তালিকায় এই সংশোধনের প্রক্রিয়া সে দেশের রাজনীতিতে রীতিমতো ঝড় তুলেছে। ভোটের মাত্র দুই-তিন মাস আগে এত বিপুলসংখ্যক নাম যে প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বাদ দেওয়া হয়েছে, বিরোধী দলগুলো তার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
বিহারের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী চারটি জেলায় বহু মুসলিমের নাম বাদ পড়েছে বলেও কংগ্রেস বা আরজেডির অভিযোগ। তবে নির্বাচন কমিশন যেহেতু বাদ পড়া ভোটারদের নাম প্রকাশ করেনি, তাই এই দাবির সত্যতা যাচাই করা কঠিন। এদিকে আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গ বা তামিলনাডুর মতো যেসব রাজ্যে বিধানসভা ভোট হওয়ার কথা, সেখানেও ভোটার তালিকায় ‘এসআইআর’ করা হবে বলে কমিশন সূত্রে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ওই সব রাজ্যে তৃণমূল বা ডিএমকের মতো যেসব দল ক্ষমতায় আছে, তারাও এর বিরোধিতা করছে।
দিল্লির রাজপথে পুলিশ ও বিরোধী এমপিদের সংঘাত
এই ‘এসআইআর’-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই এদিন বিরোধীদলীয় এমপিরা মাথায় বিশেষ ধরনের টুপি পরে ও এসআইআরবিরোধী স্লোগান দিতে দিতে সংসদ ভবন থেকে অল্প কিছুটা দূরে অশোকা রোডে নির্বাচন কমিশন অভিমুখে মিছিল করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু মাঝপথে পরিবহন ভবনের সামনেই দিল্লি পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে তাদের আটকে দেয়, তখন তারা সেখানেই অবস্থান নেন।
সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব, তৃণমূল কংগ্রেসের এমপি মহুয়া মৈত্র বা সুস্মিতা দেবের মতো কাউকে কাউকে দেখা যায় পুলিশের ব্যারিকেড টপকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। দিল্লি পুলিশ প্রথমে এমপিদের আটকানোর চেষ্টা করে। তারপর তাদের অনেককে আটক করে জোর করে বাসে তুলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
দুই পক্ষের ধাক্কাধাক্কি ও ধস্তাধস্তির সময় তৃণমূলের আরামবাগের এমপি মিতালি বাগ অচৈতন্য হয়ে রাস্তাতেই লুটিয়ে পড়েন। তার সাহায্যে এগিয়ে আসতে দেখা যায় রাহুল গান্ধীকে।
যাদের আটক করা হয় তাদের মধ্যে রাহুল গান্ধী ও মল্লিকার্জুন খড়গে ছাড়াও কংগ্রেসের প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব ও ডিম্পল যাদব, শিবসেনার (উদ্ধব গোষ্ঠী) সঞ্জয় রাউত ও প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী, তৃণমূলের মহুয়া মৈত্র, সাগরিকা ঘোষসহ অনেকেই ছিলেন।
রাহুল গান্ধী ও তার সঙ্গীদের যখন বাসে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশে গান্ধী চিৎকার করে বলে ওঠেন, ‘এটা আমাদের কোনো রাজনৈতিক লড়াই নয়। আমরা লড়ছি শুধু সংবিধানকে বাঁচানোর জন্য!’ এই লড়াই দেশের ‘ওয়ান পারসন ওয়ান ভোট’, অর্থাৎ ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ নীতির জন্য বলেও দাবি করেন তিনি।
দিল্লি পুলিশের যুগ্ম কমিশনার দীপক পুরোহিত বিরোধী এমপিদের আটক করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করলেও ঠিক কতজন আটক হয়েছেন, সেই সংখ্যাটা বলতে চাননি। তিনি শুধু জানান, ‘বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের নেতাদের আটক করে কাছাকাছি একটি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’
দিল্লি পুলিশ আরো দাবি করে, বিরোধী নেতারা যে বিশাল পদযাত্রা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের দিকে এগোচ্ছিলেন, সেই মাপের কোনো মিছিল করার অনুমতি তাদের ছিল না। দিল্লি পুলিশের ডেপুটি কমিশনার দেবেশ কুমার মাহলা বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন মাত্র ৩০ জন এমপিকে এসে দেখা করার অনুমতি দিয়েছিল। সেই জায়গায় ২০০ জনেরও বেশি এমপি মিছিল করে এগোচ্ছিলেন।’
তিনি আরো দাবি করেন, বিপুলসংখ্যক এমপির পদযাত্রায় ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ার উপক্রম’ হয়েছিল বলেই তাদের আটক করতে পুলিশ বাধ্য হয়েছে।
‘অ্যানার্কি’ সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র চলছে : বিজেপি
বিরোধী দলগুলোর এই যৌথ প্রতিবাদের রেশ মিটতে না মিটতেই বিজেপি তাদের পাল্টা আক্রমণ করে অভিযোগ তোলে, বিক্ষোভ মিছিলের নামে দেশে আসলে একটা ‘অ্যানার্কি বা চরম নৈরাজ্য তৈরির সুপরিকল্পিত কৌশল’ নেওয়া হয়েছে। রীতিমতো সংবাদ সম্মেলন করে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা ধর্মেন্দ্র প্রধান বলেন, ‘গোটা দেশ দেখতে পাচ্ছে কে সংবিধানের বিরুদ্ধে কাজ করছে—তিনি রাহুল গান্ধী!’
ধর্মেন্দ্র প্রধান আরো দাবি করেন, বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ এই প্রথম হচ্ছে না। তা ছাড়া ২০০৩ সালের পর সেখানে এসআইআর বা ‘নিবিড় পর্যালোচনা’ সম্পাদিত হয়নি। কাজেই এই প্রক্রিয়া অনেক আগেই সম্পাদিত হওয়া উচিত ছিল।
গত বছর মহারাষ্ট্রে বিধানসভা নির্বাচনের সময় থেকেই কংগ্রেস ‘ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন’ (ইভিএম) নিয়ে মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন, যা বিজেপির মতে ‘অরাজকতা সৃষ্টির একটা ষড়যন্ত্র’।
এ ছাড়া সংসদের সামনে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রের সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজুও হুঁশিয়ারি দেন, ‘নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে লাগাতার আক্রমণ শানানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু সরকার সেটা আর কিছুতেই বরদাশত করবে না।’
এদিকে দিল্লিতে পুলিশ-প্রশাসন ও বিরোধী নেতানেত্রীদের এই সংঘাতের জের এসে পড়ে সংসদের ভেতরেও, উভয় কক্ষের অধিবেশনই দুপুর ২টা পর্যন্ত মুলতবি করে দেওয়া হয়।
‘এসআইআর’ নিয়ে এত বিতর্ক কেন
ভারতের জাতীয় নির্বাচন কমিশন বিহারে ভোটার তালিকা পর্যালোচনার যে কাজ গত ২৫ জুন থেকে ২৬ জুলাই ধরে সম্পন্ন করেছে, তা এরই মধ্যে দেশের সুপ্রিম কোর্টেও চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে।
কমিশনের বিরুদ্ধে যারা আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন, তারা যুক্তি দিচ্ছেন, এই প্রক্রিয়া অবৈধ। কারণ এভাবে লাখ লাখ নাম তালিকা থেকে দেওয়ার অধিকারই নির্বাচন কমিশনের নেই।
ভোটের মাত্র তিন-চার মাস আগে সম্পাদিত এই প্রক্রিয়ার ‘টাইমিং’ নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কারণ বাদ পড়া ভোটাররা আপিল করলেও তার নিষ্পত্তির জন্য হাতে যথেষ্ট সময় থাকবে না।
বিরোধী দলগুলো প্রকাশ্যেই অভিযোগ তুলছে, যেসব সম্প্রদায়ের লোকজন বহু দিন ধরে তাদের ভোট দিয়ে আসছেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাদের নাম তালিকা থেকে বাদ দিতেই নির্বাচন কমিশন বিজেপির নির্দেশে এই ‘এসআইআর’ করার কাজে হাত দিয়েছিল। সত্যিকারের ভোটারদের নাম যাচাই-বাছাই করার ‘আধার কার্ডে’র মতো সরকারের জারি করা পরিচয়পত্র বা এমনকি নির্বাচন কমিশনেরই জারি করা ভোটার পরিচয়পত্র পর্যন্ত মানতে অস্বীকার করা হয়েছে বলে বিরোধী নেতারা জানাচ্ছেন।
শীর্ষ আদালত অবশ্য এসআইআর প্রক্রিয়াতে কোনো স্থগিতাদেশ দিতে এখনো রাজি হোননি। তবে তারা বলেছেন, কোনো ‘প্রকৃত ভোটারে’র নাম যাতে তালিকা থেকে বাদ না পড়ে এবং যে ৬৫ লাখ মানুষের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছে তারা যাতে আপিল করার মতো যথেষ্ট সময় পান সেটা কমিশনকে নিশ্চিত করতে হবে।
ভারতের নির্বাচন কমিশন অবশ্য সব সমালোচনা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করে বলেছে, দেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করতেই এই সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং তাদের সব প্রক্রিয়ায় ‘স্বচ্ছ্বতার কোনো অভাব নেই’। পাশাপাশি বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী তার যাবতীয় অভিযোগ সব প্রমাণসহ একটি স্বাক্ষরিত হলফনামার আকারে পেশ করুন—তাকে এই পাল্টা চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দিয়েছে কমিশন।