সংসদের উচ্চকক্ষ নিয়ে ঐকমত্য না হওয়ায় বাদ পড়তে পারে প্রস্তাব
সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেওয়ায় এ প্রস্তাব বাদ পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতিতে বিএনপিসহ কিছু দল চায় নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠিত হোক, আর জামায়াত ও এনসিপিসহ অধিকাংশ দল চায় প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (ভোটের অনুপাতে) ভিত্তিতে গঠন হোক। এই মতবিরোধের কারণে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে উচ্চকক্ষ বাতিলের প্রস্তাব উঠে এসেছে।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি অনানুষ্ঠানিকভাবে উচ্চকক্ষের প্রস্তাব ‘পরিত্যক্ত’ করার পক্ষে মত দিয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আগামী সপ্তাহের সংলাপে জানানো হবে।
সংবিধান সংশোধন ও গণভোট নিয়ে ঐকমত্য
উচ্চকক্ষ নিয়ে মতভেদ থাকলেও সংবিধান সংশোধনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং নির্দিষ্ট বিষয়ে গণভোট আয়োজনের প্রস্তাবে বেশিরভাগ দল একমত হয়েছে। বিএনপি ও জামায়াত প্রস্তাব করেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যেন ভবিষ্যতে কেউ বাতিল করতে না পারে, তার জন্য সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনতে গণভোট বাধ্যতামূলক করা হোক।
সংলাপে বিভিন্ন দলের অবস্থান
ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ১৪তম সংলাপে দেখা গেছে, বিএনপি পিআর পদ্ধতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কমিশন চাইছে উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনের সুযোগ থাকুক, কিন্তু বিএনপি এতে সম্মত নয়।
অন্যদিকে, জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অধিকাংশ দল উচ্চকক্ষ চায়। তিনটি দল না চাইলে পুরো প্রস্তাব আটকে যাওয়া হবে বৈষম্যমূলক। এনসিপির মতে, বিএনপি ও তার মিত্ররা পিআর ভিত্তিক উচ্চকক্ষের বিরোধিতা করে আলোচনাই বাদ দিতে চাইছে, যা মৌলিক সংস্কারের পথে বাধা।
কমিশনের অবস্থান ও পরবর্তী পদক্ষেপ
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, উচ্চকক্ষ যদি গঠিত না হয়, তাহলে সংবিধান সংশোধনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও নির্দিষ্ট অনুচ্ছেদে গণভোট প্রয়োজন হবে। এই অনুচ্ছেদগুলো হলো—৮, ৪৮, ৫৬, ১৪২ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ৫৮ক, ৫৮খ ও ৫৮ঙ।
বিএনপির প্রস্তাব ও ভবিষ্যৎ অবস্থান
বিএনপি বলছে, ভবিষ্যতে যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কোনোভাবে বাদ দেওয়া না যায়, সে জন্য এ বিষয়ে গণভোট বাধ্যতামূলক করতে হবে। দলটি বলেছে, উচ্চকক্ষ গঠন না হলে জনগণের অর্থ অপচয় এড়ানো যাবে। এছাড়া আর্থিক সক্ষমতা এবং কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে তারা।
জামায়াতের অবস্থান: গণভোটই চূড়ান্ত সমাধান
জামায়াত মনে করে, রাজনৈতিক সংস্কারে মতানৈক্য থাকলে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি জনগণের ভোটে হওয়া উচিত। তারা উচ্চকক্ষে ছোট দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে প্রোপোরশনাল পদ্ধতির পক্ষে রায় দিয়েছে।
গণভোটের পক্ষে এনসিপিসহ কয়েকটি দল
জাতীয় সংলাপে সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নে গণভোটের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, অনুচ্ছেদ ৪৮ ও ৫৬ এবং ভবিষ্যতে সংযোজনযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ যদি পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়, তাহলে তা অবশ্যই গণভোটের মাধ্যমে করতে হবে। পাশাপাশি তিনি প্রস্তাব করেন, সংবিধান সংশোধনের জন্য কেবল সংসদের নিম্নকক্ষ নয়, উচ্চকক্ষেও দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থনের বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন্দ বলেন, “প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা হিসেবে প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতি চালু না হলে আবারও একটি গণ-অভ্যুত্থান ঘটতে পারে। প্রহসনের গণভোট নয়, আমরা চাই কার্যকর গণভোট।”
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়ে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট সমাধানে পৌঁছানো যায়নি। তিনি বলেন, দীর্ঘ আলোচনার পরেও কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় অনেকেই হতাশ।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, গণভোটসহ সংবিধান সংশোধনের মতো মৌলিক বিষয়গুলোতে এখনো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তিনি সব দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সবাইকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে, না হলে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।